
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যেকার গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিগুলো স্থগিত হওয়ার ফলে দুই দেশের সম্পর্ক কেমন হতে পারে?
Progga News Desk:
কাশ্মীরের পহেলগামে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হওয়ার পর থেকে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কে অবনতি ঘটেছে। এই হামলার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আটারি সীমান্ত বন্ধ করা, কূটনৈতিক কর্মীদের সংখ্যা কমিয়ে আনা, ভিসা নিষেধাজ্ঞা, পাশাপাশি ছয় দশকের পুরনো সিন্ধু পানি চুক্তির বাস্তবায়ন স্থগিত করাসহ বেশ কয়েকটি কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত।
ভারতের এই পদক্ষেপের বিপরীতে পাল্টা পদক্ষেপ নিয়েছে পাকিস্তান। তাঁরা তাদের আকাশসীমা এবং ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধের পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে, যা ভারতের সাথে এ সংক্রান্ত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্থগিত করার ইঙ্গিত দেয়। ভারতের মতো পাকিস্তানও প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ও তাদের সহকারীদের দেশ ছাড়তে বলেছে এবং কূটনৈতিক কর্মীদের সংখ্যা কমাতে বলেছে।
বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফের সভাপতিত্বে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারত সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা প্রত্যাখ্যান করা হলো। বলা হয়েছে, এই চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানের অংশের পানির প্রবাহ থামানো বা দিক পরিবর্তনের যেকোনো প্রচেষ্টা যুদ্ধ ঘোষণার শামিল বলে বিবেচিত হবে। সেই সাথে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সিমলা চুক্তিসহ সব দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্থগিত করার অধিকার প্রয়োগ করতে পারে।
শুধু সিন্ধু-সিমলা চুক্তি নয়, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বেশ কয়েকটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি আছে ।পাকিস্তানে ভারতীয় হাইকমিশনের ওয়েবসাইট অনুসারে, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে মোট ৪০টি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি রয়েছে।
এই চুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য, ভিসা প্রদান, পারমাণবিক অস্ত্রের তালিকা বিনিময়, সীমান্ত নিরাপত্তা, পারমাণবিক পরীক্ষার ব্যাপারে আগাম সতর্কতা থেকে শুরু করে সিন্ধু পানি চুক্তি, সিমলা ও তাসখন্দ চুক্তি এবং পানি বণ্টন সম্পর্কিত লাহোর ঘোষণাপত্র।
এই ৪০টি দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চুক্তি গুলো হলো:-
- কাস্টমস অর্থাৎ শুল্ক সংক্রান্ত বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তি।
- পারমাণবিক অস্ত্রের দুর্ঘটনা প্রতিরোধ চুক্তি।
- ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার বিষয়ে আগাম জানানো সংক্রান্ত চুক্তি।
- দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়ে লাহোর ঘোষণাপত্র।
- উভয় দেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন প্রতিরোধ এবং সামরিক বিমান অবতরণ ও উড্ডয়ন সংক্রান্ত চুক্তি।
- সামরিক অনুশীলন এবং সেনাবাহিনীর গতিবিধি সম্পর্কে আগাম তথ্য বিনিময় চুক্তি।
- পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি।
- সাংস্কৃতিক সহযোগিতা ও প্রচার সংক্রান্ত চুক্তি।
- বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পর্যটন এবং শিল্প খাতে সাধারণ স্বার্থের জন্য যৌথ কমিশন প্রতিষ্ঠার চুক্তি।
- চেনাব নদীর ওপর সালাল জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র সংক্রান্ত চুক্তি।
- টেলিযোগাযোগ সংক্রান্ত চুক্তি।
- বিমান পরিষেবা সংক্রান্ত চুক্তি।
- রেলওয়ে যোগাযোগ সংক্রান্ত চুক্তি।
- পারস্পরিক বাণিজ্যের বিভিন্ন সময়কালে সম্পাদিত চুক্তি।
- পাকিস্তান ও ভারতের সাথে বাণিজ্য সংক্রান্ত চুক্তি।
- ভিসা প্রাপ্তির চুক্তি।
- ১৯৭১ সালের যুদ্ধের আগে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে মুক্তি এবং প্রত্যাবাসনের চুক্তি, যেকোনো দেশে আটক ব্যক্তিদের তালিকা।
- দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়ে সিমলা চুক্তি।
- ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে চুক্তি।
- তাসখন্দ চুক্তি।
- সিন্ধু জল চুক্তি।
- সীমিত অর্থ প্রদান বা তহবিল স্থানান্তরের বিষয়ে চুক্তি।
- সিন্ধু জল ব্যবস্থায় বিভিন্ন সময়ে অ্যাডহক ভিত্তিতে জল বণ্টনের বিষয়ে চুক্তি।
- আর্থিক বিষয়ে চুক্তি।
- ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে রেলপথ পুনর্বাসন চুক্তি।
- সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষার জন্য নেহরু-লিয়াকত বা দিল্লি চুক্তি।
- ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ব্যাংকিং সম্পর্কিত চুক্তি।
- বিমান পরিষেবা সম্পর্কিত চুক্তি।
- ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আয়ের উপর দ্বৈত কর পরিহারের বিষয়ে চুক্তি।
যদিও গত ৭৭ বছরে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে কমবেশি ৪০টি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তবে এর মধ্যে কয়েকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হলো:-
- সিমলা চুক্তি ( ১৯৭২ সালের দোসরা জুলাই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় )
- পারমাণবিক স্থাপনার ওপর হামলা নিষিদ্ধ করার চুক্তি (১৯৮৮ সালের ৩১শে ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয় এবং ১৯৯১ সালের ২৭শে জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়)।
- সেনা মহড়া ও সামরিক গতিবিধি সম্পর্কে আগাম বার্তা চুক্তি ( ১৯৯১ সালের ৬ই এপ্রিল স্বাক্ষরিত হয়)।
- আকাশসীমা লঙ্ঘন রোধ ও সামরিক বিমান সংক্রান্ত চুক্তি (১৯৯১ সালের ৬ই এপ্রিল স্বাক্ষরিত হয়)।
- ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার বিষয়ে অগ্রিম জানানোর চুক্তি (২০০৫ সালের তেসরা অক্টোবর স্বাক্ষরিত হয়)।
- পারমাণবিক অস্ত্র সংক্রান্ত দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমানোর চুক্তি (২০০৭ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি স্বাক্ষরিত হয়)।
- লাহোর ঘোষণাপত্র (১৯৯৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে এই দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল)।
- ধর্মীয় স্থান ভ্রমণ সংক্রান্ত চুক্তি (১৯৭৪ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর উভয় দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে স্বাক্ষরিত হয়েছিল)।
- নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি, যা দিল্লি চুক্তি নামেও পরিচিত (১৯৫০ সালের ৮ই এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল)।
- সিন্ধু পানি চুক্তি (সিন্ধু নদী এবং এর উপনদীগুলির পানি বণ্টনের জন্য বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় নয় বছর ধরে আলোচনার পর ভারত ও পাকিস্তান ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বরে সিন্ধু পানি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে)।
সিমলা চুক্তি এবং অন্যান্য চুক্তি স্থগিত করার ফলে দুই দেশের সম্পর্ক কেমন হতে পারে?
ভারতের পক্ষ থেকে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান বলেছে, পানির প্রবাহ বন্ধ করা বা দিক পরিবর্তনের যেকোনো চেষ্টা 'যুদ্ধ ঘোষণার সামিল' বলে মনে করা হবে এবং ভারতের সঙ্গে সিমলা চুক্তিসহ সব দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্থগিত করার অধিকার পাকিস্তানের আছে।
এই বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে, কায়েদ-ই-আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ড. ইশতিয়াক আহমেদ বলেছেন, যদি এই সব দ্বিপাক্ষিক চুক্তি যেকোনো স্তরে বাস্তবায়ন বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে উত্তেজনা ও টানাপোড়েন আরও বাড়বে। তার মতে, যেসব দেশ পারমাণবিক অস্ত্র রাখে, তাদের মধ্যে এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি বাতিল করা পুরো অঞ্চলের ভারসাম্য নষ্ট করবে।এর ফলে সৃষ্ট উত্তেজনা দুই দেশকে প্রচলিত যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে।
ড. ইশতিয়াকের মতে, এই চুক্তিগুলো স্থগিত করা হলে উভয় দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং তাদের অর্থনীতির ওপরও প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, যদি পাকিস্তান ভারতের মতো একতরফাভাবে কাজ করে একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্থগিত করে, তাহলে সেক্ষেত্রে তারা আন্তর্জাতিক চাপের সম্মুখীনও হতে পারে।
ড. ইশতিয়াক আহমেদ আরও বলেন, যেসব চুক্তির মধ্যস্থতায় আন্তর্জাতিক সংস্থা বা শক্তিধর রাষ্ট্র জড়িত, সেখানে একতরফা হস্তক্ষেপ বা পরিবর্তন সহজে সম্ভব নয়।
অন্যদিকে, বিশ্লেষক হুমা বাকাই বিবিসিকে বলেন, সিমলা চুক্তিকে এমন একটি হুমকি বলা যেতে পারে যা যেটির খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। তবে ভারতের সঙ্গে হটলাইন, পারমাণবিক অস্ত্র সংক্রান্ত চুক্তি, এবং লাইন অফ কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ রেখা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক চুক্তি রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্থগিত করার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থাকতে পারে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কখনই চাইবে না যে দুটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও খারাপ হোক যে তারা সংঘর্ষের দিকে ধাবিত হোক। সূত্র:বিবিসি